মোহাম্মদ আবু তাহের
প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাসের কারণে সব কিছুই অচল। ঘরবন্দি শুধু গোঠা দেশের মানুষই নয় পৃথিবীর প্রায় সব মানুষই এখন ঘরে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। করোনার সংক্রমন ঠেকাতে দোকানপাঠ ও বাজারের জন্য বেঁধে দেয়া হয়েছে নির্দিষ্ট সময়। সীমিত থাকারে ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু রাখার ঘোষনা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় ১৯ এপ্রিল থেকে দৈনিক ব্যাংকিং লেনদেনের সময়সূচি হবে সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত। সরকার দেশের নাগরিকদের জানমালের হেফাজত করতে বদ্ধপরিকর। মানুষকে বাঁচানোর জন্যই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, ঘরে থাকা ও বিনা প্রয়োজনে ঘরের বাহিরে না যাওয়া ইত্যাদি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ব্যাংকের অনেক গ্রাহক সামাজিক দূরত্বের বিষয়টি আমলেই নিচ্ছেন না বলে দৃশ্যমান হয়। বরং লেনদেনের সময়সীমা কম থাকায় ব্যাংকিং প্রয়োজনে গ্রাহকদের একধরনের উৎসবমুখর অবস্থায় ঠাসাঠাসি করে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকাতে দেখা যায়। অর্থাৎ একটি ব্যাংকের শাখা সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত লেনদেনের সময়সীমায় যে পরিমান গ্রাহকদের সেবা দেয়া হতো বর্তমানে ৩ ঘন্টার মধ্যেই সেই পরিমান বা এর চেয়ে বেশি গ্রাহকদের ব্যাংকিং সেবা দিতে হয়। সুতরাং ব্যাংকে গ্রাহকরা সচেতন থেকে সীমিত সময়ের মধ্যে হলেও সামাজিক দূরত্ব ও শারীরিক দূরত্বের বিষয়টি আমলে নেয়া একান্ত প্রয়োজন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মূখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেছেন, সারা বিশ্বের মতো দেশে এখন মহামারি করোনা ভাইরাসের কারণে ক্রান্তিকাল চলছে। সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। কিন্তু দেশ ও মানুষের স্বার্থে এ দুর্যোগের সময়ে জীবনের ঝুকি নিয়ে ব্যাংক কর্মীরা সীমিত আকারে ব্যাংকিং সেবা দিতে হচ্ছে। পুলিশসহ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সেনাবাহিনী সহ সরকারের অনেক সংস্থা মাঠে কাজ করছে। তিনি বলেন, এসময়ে ব্যাংক পুরোপুরি বন্ধ করে দিলে অর্থনীতিতে আরও ভয়াবহ প্রভাব পড়বে। ব্যাংক গুলোকে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে সেবা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
১১ এপ্রিল শনিবার লকডাউন এলাকায় ছয় রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক খোলা রেখে লকডাউন ঘোষিত এলাকা গুলোতে সীমিত আকারে ব্যাংকিং সেবা চালু রাখার প্রজ্ঞাপন জারি করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংক।
ব্যাংক হলো লক্ষ লক্ষ সঞ্চয়ি মানুষের আস্থা ও ভরসার স্থল। ব্যাংক কর্মকর্তরা হলেন গ্রাহকের আস্থার প্রতীক। ব্যাংক হলো অর্থনীতির হৃতপীন্ড। বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্য সীমিত আকারে ব্যাংকি কার্যক্রম চালু রেখেছেন।
সরকার লকডাউন ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার বিষয়ে সে সমস্ত প্রদক্ষেপ নিয়েছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কাঁচাবাজার ও মাছ বাজারে মানুষের তীব্র ভীড় লক্ষ করা যায়। করোনা ভাইরাস আতংকে মানুষের জীবন যাত্রা থমকে গেছে। নি¤œ আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ বর্তমান পরিস্থিতিতে চরম বিপাকে পড়েছে। ওদের চোখেমুখে বিষন্নতা। করোনা সতর্কতায় বিভিন্ন জেলায় জেলায় ও অঞ্চলে লকডাউন হচ্ছে, সবাইকে ঘরে থাকার কথা বলা হচ্ছে। এর পরও কিছু কিছু খেটে খাওয়া মানুষ জীবিকার তাগিদে বের হচ্ছেন সংসারের খাবার যোগাতে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক জরিপে দেখা গেছে সরকারি ছুটি বা সামাজিক দূরত্বের ফলে দেশে ৭২ শতাংশ মানুষ কাজ হারিয়েছে। অথবা কাজ কমে গেছে। ৮ শতাংশ মানুষের কাজ থাকলেও এখনো বেতন পায়নি। ৫১ শতাংশ রিক্সা চালক, ৫৮ শতাংশ কারখানা শ্রমিক, ৬২ শতাংশ দিনমজুর, ৬৬ শতাংশ হোটেল রেস্তোরা কর্মী জানায় চলতি মাসে তাদের আয় নেমে এসেছে শূন্যের কোটায়। দেশব্যাপি কাজ হারানো এসব মানুষের কাছে দ্রæত খাদ্য পৌঁছাতে না পারলে তাদের ঘরে রাখা সম্ভব হবে না। জীবিকা অর্জনে তারা ঘর থেকে বের হতে বাধ্য হবে। করোনা লকডাউনের কারণে দ্রæত গতিতে ক্ষুধা সংকট বাড়ছে বিশ্বের অন্যতম উন্নত দেশ ব্রিটেনে। খাদ্য শেষ হয়ে গেছে বহু পরিবারের। পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে বলে সতর্ক করেছে ফুড ফাউন্ডেশন নামের একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান। লকডাউনের কারণে ১৫ লাখ মানুষ খাদ্য সংকটে পড়েছে।
করোনা মহামারীর কারণে যুক্তরাষ্ট্রেও অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে এসেছে। সেখানে প্রায় পৌনে দুই কোটি মানুষ চাকুরি হারিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও রয়েছে বড় ধরণের ঝুঁকি। বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়ের প্রধান উৎস হলো রেমিটেন্স ও তৈরি পোষাক। করোনা ভাইরাসের এই সংকটে রেমিটেন্স খাতে আমাদের বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এডিবির মতে করোনা ভাইরাসের কারনে বিশ্ব অর্থনীতি থেকে ৪ মিলিয়ন ডলার হারিয়ে যাবে। আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা আক্সফাম এর মতে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে করোনা ভাইরাস এ বছর পিছিয়ে দিল। আইএমএফ পূর্বাভাস দিয়েছে বৈশ্বিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারে ২০২০ সালে নি¤œগতি লক্ষ করা যাবে। করোনাভাইরাস পৃথীবির উন্নত ও উন্নয়নশীল এবং দরিদ্র দেশ সবাইকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর এক নম্বর অর্থনৈতিক শক্তি। তারাই ব্যর্থ হয়েছে করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ রাখতে। প্রায় ১৫০জন বাংলাদেশী মানুষ সেখানে মারা গেছে। এখন নিউইর্ককে বলা হয় মৃত্যুপুরি। যেখানে কবরস্থানের পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় হাসপাতালের সামনে বড় বড় ফ্রিজ রাখা হয়েছে মৃত দেহ গুলো রাখার জন্য। যুক্তরাষ্ট্র সহ ইউরোপের বড় বড় দেশ গুলোর বড় বড় শহর এখন লকডাউন। মানুষ এখন জীবন মৃত্যুর মাঝখানে বসবাস করছে। সৌদি রাজ পরিবারের সদস্যরা ও করোনা আক্রান্ত। তারা অনেকেই এখন কোয়ারেন্টেইনে। ক্ষমতা, প্রভাব প্রতিপত্তি দিয়ে সব কিছু সব সময় হয় না। পুরো বিশ্বকে করোনাই দেখিয়ে দিল করোনা ভাইরাসের কাছে ধনী গরীব নেই। মৃত্যুর ক্ষেত্রে করোনা কাউকে করুনা করে না। তার মাঝে কোনো বৈষম্য নেই। করোনা যেন এক মানবিক সাম্যের কথাই জানিয়ে দিয়ে যায়। উগ্রবাদ সাম্প্রদায়িকতা ধর্মীয় বৈষম্য পৃথিবীতে মানুষের মানবিক মূল্যবোধকে নষ্টই করেনি মানুষ একে অপরের দুশমনে পরিণত হয়েছে।
করোনা ভাইরাসের এই সংকঠময় সময়ে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী ব্যক্তি বিল গেটস কিছু মূল্যবান হৃদয়স্পর্শি কথা বলেছেন, যা পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করা হল (১) আমাদের দেশের সংস্কৃতি, ধর্ম, আর্থিক অবস্থা ও খ্যাতি ইত্যাদির পরও প্রকৃতিগত ভাবে আমরা সবাই সমান। যিনি যত বড় খ্যাতিমান বা ক্ষমতাবান হোন না কেন-যে কোনা সময় আপনি কঠিন সংকটেপড়ে যেতে পারে। করোনা ভাইরাস এই জিনিষটিই আমাদের খুব ভালো করেই বুঁঝিয়ে দিয়েছে। যদি আপনি বিশ্বাস না করেন তবে টম হ্যাংকস অথবা প্রিন্স চার্লসকে দেখেই বুঝতে পারবেন।
(২) আমরা সবাই একে অপরের সাথে দারুনভাবে সম্পৃক্ত। জগতের সব কিছুই একটি অনুবন্ধনে আবদ্ধ। সীমান্ত রেখাগুলো আসলেই মিথ্যা। ওগুলোর মূল্য কত কম তা এই ভাইরাস বুঝিয়ে দিয়েছে। আপনারা ভাল করেই দেখেছেন সীমান্ত পাড়ি দিতে ভাইরাসের ভিসা পাসপোর্ট কোনো কিছুই লাগেনা।
(৩) গৃহের স্বল্প সময়ের এই বন্ধীত্বকে যদি আপনার নিপীড়ন মনে হয় তবে একটু ভালোভাবে বুঝার চেষ্টা করুন। যারা সারাজীবন এমন নিপীড়নের মাঝ দিয়ে যাচ্ছেন তাদের জীবনটা কেমন।
(৪) ভাইরাস বুঝিয়ে দিয়েছে জীবন খুবই সংক্ষিপ্ত। যে কোন সময় জীবনের ইতি হয়ে যেতে পারে। এই সংক্ষিপ্ত জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে বয়স্ক ,,শিশুদের বেশী করে যতœ নেয়া। এদের একদল পৃথিবী দেখার জন্য আরেক দল পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে।
(৫) ভাইরাস স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে কত স্বার্থপর আমরা। জড়বাদী, ভোগবাদী আর বিলাসের সমাজই আমরা তৈরি করেছি। সংকটময় মূহুর্তে বোঝা যায় জীবনের সব চেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিষগুলো হচ্ছে-খাদ্য, পানি আর ঔষধ। দামি বাড়ি, গাড়ি আর লাক্সারিয়াস রিসোর্ট নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে দামি বাড়ি গাড়ি একজন মানুষকে বাঁচাতে পারেনা। যেমন পারে ঔষধ খাবার আর পানি।
(৬) ক্ষমতার দম্ভ, খ্যাতির দম্ভ, বিত্তের দম্ভ, এসব কিছুই নিমিষে যে কোনো সময় চুপসে, যেতে পারে। বড় কোনো শক্তির কাছে নয়। অতিক্ষুদ্র এক আনুবিক্ষনিক ভাইরাসের কাছে। পুরো দুনিয়াটাকে অচলাবস্থায় নিয়ে যেতে পারে খালি চোখে অদেখা এক ভাইরাস। তাই আমরা সব রকমের দম্ভকে যেন নিয়ন্ত্রনের মধ্যেই রাখি।
(৭) আমরা সাবধান হবো না কি শুধুই শংকিত হবো এটাও ভাইরাস আমাদের মনে করিয়ে দেয়। এরকম অবস্থা অতিতেও হয়েছে। সুতরাং মনে রাখতে হবে পৃথীবির কোনো সংকটই দীর্র্ঘস্থায়ী নয়। জীবন আবর্তিত হতে থাকবেই। প্রতিটি সংকটের পর সুসময় আসবেই। এই সংকটও কেটে যাবে। পৃথিবীর এখানেই শেষ নয়। কাজেই অতিরিক্ত আতংকগ্রস্থ না হয়ে আমরা যেন নিজেদের আরো বেশী ক্ষতি করে না ফেলি।
(৮) এই ভাইরাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে-আমরা যেন ভুলে না যাই। শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেদের সংশোধন করি। অনেকেই করোনা ভাইরাসকে গ্রেট ডিজেষ্টার হিসাবে দেখছেন। আমরা এটাকে গ্রেট কারেক্টর হিসাবেই দেখতে চাই।
করোনা গোটা মানবজাতির জন্য মহাবিপদ স্বরূপ। এর জন্য দায়ীও মানবজাতি। সর্বশক্তিমান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, তোমাদের যে বিপদ আপদ তা তো তোমাদেরই কৃতকর্মের ফল। তা সত্তে¡ও তোমাদের অনেক অপরাধ আল্লাহ ক্ষমা করে দেন (সূরা আশ-শুরা আয়াত ৩০)
বিপদাপদে ধৈর্যশীল থাকার তাগিদ ও দিয়েছেন আল্লাহ তায়ালা-মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, (তারাই ধৈর্যশীল) যারা তাদের উপর কোনো বিপদ আপদ এলে বলে আমরা তো আল্লারই। আর নিশ্চিতভাবে তারই দিকে ফিরে যাবো। এইসব লোকের প্রতি তার প্রতিপালকের কাছ থেকে দয়া পতিত হয়। আর এরাই সঠিক পথপ্রাপ্ত। সূরা বাকারা (১৫৬-৫৭)।
দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষিখাতে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষনা করেছেন। তিনি করোনা ভাইরাসের মহামারী থেকে বাঁচতে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করে ঘরে বসে বেশি বেশি নামাজ ও দোয়া পড়ার আহŸান জানিয়েছেন। এ কাজটি আমরা যত বেশি করতে পরবো ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। আল্লাহই প্রত্যেক প্রাণীর রিজিক দাতা। সূরা হুদ এর ০৬ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন পৃথিবীতে বিচরণশীল এমন কোনো জীব নেই যার রিজিক (পৌছানোর দায়িত্ব) আল্লাহর উপর নেই। তিনি (যেমন) তার আবাস সম্পর্কে অবহিত, (তেমনি তার মৃত্যুর পর) তাকে যেখানে সোপর্দ করা হবে তাও তিনি জানেন।
লেখকঃ কলামিষ্ট, ব্যাংকার ও গবেষক।