সরওয়ার আহমদঃ
হাল আমলের মতো গ্রামীণ জীবনযাত্রায় কৃষিই ছিলো প্রধান ভরসা এবং উপজীব্য। শেষ রাতে মোয়াজ্জিনের আযান ধ্বনির পরপরই যে ধ্বনি পরিবারকে উচ্চকিত করতো সেটি হচ্ছে গৃহস্থের রুটিন মাফিক হাকডাক। “বিহান হলো জাগোরে ভাই ডাকে পরস্পরে”র মতো হাঁটি বাধা বাড়ীর কৃষকরা পরস্পরের হাকডাকে জেগে উঠতো। হাত মুখ ধূয়ে কৃষকরা প্রথমে ঢুকতো গোয়াল ঘরে। হালের উপযোগী বলদকে খর বিছালী খাওয়ানোর ব্যবস্থা করে নিজেও পাকশালায় ঢুকে পান্তাভাত খেয়ে মাঠ অভিমুখে রওয়ানা হতেন কালের কৃষক। তাদের হৈ হুঁই শব্দে জেগে উঠতো পাড়া মহল্লা। দিনমণি তার পূর্ণ অবয়ব ধরার আগেই অর্ধেক খেতে লাঙ্গঁল চালনা সম্পন্ন করে ফেলতেন দক্ষ কৃষক। অবারিত মাঠ এবং মুক্ত আকাশের সংস্পর্শে কৃষক হৃদয়ে আবেগের সুঁড়সুঁড়ি লাগতো। ভাবের দরিয়া উথলি উঠতো নির্বিঘেœ। তাই কেহ গলা ছেড়ে গান ধরতো-আর কতো কাল থাকবোরে দয়াল তোমার আশায় পন্থ চাইয়া, আমার আশায় আশায় জনম গেলো দিনতো যায় মোর গইয়া… রে দয়াল তোমার আশায় পন্থ চাইয়া। মাঠের এক প্রান্তে কৃষকের ভরাট গলার আওয়াজ শুনে অন্য প্রান্তের কৃষকের হৃদয়ে ভাবোদয় হতো। সেও গেয় উঠতো- মুর্শীদও নিরঞ্জন, আছো তুমি গোপনে… চরণ পাইমো কেমনে। এভাবে গানে মজে উঠতো সকালের ফসলী মাঠ। ঘরের গৃহস্থ যখন সাত সকালে মাঠ অভিমুখী হয়েছে, তখন গৃহিনীরও কর্ম ব্যস্ততা শুরু হতো ঘরে। উনুনে হাঁড়ি বসিয়ে পুকুর ঘাট থেকে আরম্ভ করে বাড়ীর উঠোন আঙ্গিঁণার প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করতেন দ্রুত গতিতে। অত:পর মাঠে হাল চাষরত গৃহস্থ এবং চাকর বাকরদের জন্য সকালের নাস্তা পাটানোর ব্যবস্থা করতেন। নাস্তার উপকরণে ছিলো রকমফের। সাধারণত ভাত তরকারি, তার সাথে ভর্তা ছিলো বাধ্যতা মূলক। নাস্তার এক ঘেয়েমী এড়াতে কখনও বিরণী চালের ক্ষীর, আতপ চালের খিচুড়ী অথবা চিতই পিঠা ও শাক ভাজা পরিবেশন করা হতো। মাঠে হাল চাষরতদের জন্য নাস্তা নিয়ে যাবার অভিজ্ঞতা লেখকেরও আছে। সকালে ৮ টায় মধ্যে মাঠে নাস্তা না পাঠালে গৃহিনীকে কৈফিয়ত দিতে হতো। হাল চালকরা হালবাওয়ার সাথে সাথে বাড়ীর দিকেও নজর রাখতো- নাস্তা নিয়ে কেউ আসছে কিনা। জমির আইলের কিনারে বসে খাওয়ার আলাদা রুচি ছিলো। মাঠে কর্মরতরা এক বউল ভাত সাবাড় করতে পারতো সহজেই। নাস্তা শেষে হুককায় কিংবা বিড়িতে অবিরাম দম নিয়ে কৃষক যখন লাঙ্গঁল চালাতেন, তখন তাকে বীরসেনানীর মতো প্রতীয়মান হতো।
গ্রামজনপদের গৃহস্থদের মধ্যে সর্বক্ষেত্রেই স্বাবলম্বীতার ছাপ ছিলো। বাড়ীর উঠোনের কিনারে অথবা আঙ্গিঁনায় মৌসুমী তরিতরকারী ফলানোর নিয়ম ছিলো প্রতিটি গৃহস্থ পরিবারে। এ ক্ষেত্রে গৃহিণীদের উদ্যম ছিলো বেশী মাত্রায়। উদ্বৃত্ত তরিতরকারী বিক্রয়ের পাশাপাশি প্রতিবেশীদেরকেও বন্টন করা হতো। শীত মৌসুমে সবজি চাষাবাদের বাস্তবতা ছিলো বহুমাত্রিক। রোপা আমন মৌসুমের বীজতলাকে গোবর সমৃদ্ধ করে হাল চাষ শুরু হতো আশ্বিন মাস থেকেই। তারপর একই জমিকে ভাগ করে রোপন করা হতো আলু, পেয়াজ, টমেটো, মূলা, লাইশাক, মরিচ, বাখর, বেগুনসহ অন্যান্য তরিতরকারি। সম্পন্ন গৃহস্থরা সরিষা, তামাক, তিল এবং বুট চাষাবাদও করতেন। মৌসুমী কালে আদা এবং হলুদের চাষও হতো। অর্থাৎ লবণ ব্যাতিরেকে গৃহস্থালীর বাকী সব পণ্য যাতে নিজস্ব উৎপাদন থেকে যোগান দেয়া যায়, সে পদ্ধতি অবলম্বয় করতেন সেকালের গৃহস্থরা। ফলানো সরিষা থেকে তেল তৈরীর ঘানি বা কলু প্রতি এলাকাতেই ছিলো। ঘানির তৈরী সরিষা তেলের খ্যাতি ছিলো সর্বজনবিদিত। এই তেলের ইলিশ ভাঁজা কিংবা রান্না মাংস ছিলো সরস এবং উপাদেয়।
(——–চলবে)
লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক
পর্ব-৮ দিন গুলো মোর সোনার খাঁচায় রইলো না
