পর্ব-৪
সরওয়ার আহমদঃ
সেকালের গ্রামীণ যাতায়াত ব্যবস্থার পুরো চিত্র হয়তো বাক্যবন্ধী করা সম্ভব হবে না। তবে যাত্রা পথ সুগম ছিলো না। গল্প শুনেছি- পিতা মহ কিংবা প্র-পিতামহরা মামলা মোকদ্দমা উপলক্ষে কি ভাবে সিলেট যাওয়া আসা করতেন। গ্রাম হতে সিলেট যেতে হলে মধ্যরাতে ঘুম থেকে উঠে আরেক মধ্যরাতে বাড়ী ফিরতেন পূর্বসূরীরা। মধ্যরাতে ঘুম ত্যাগ করে খাবার দাবার সম্পন্ন করত “পূবে ধল” (ফজরের আযানের আগ মুহুর্তে) পায়ে হেটে রওয়ানা হতেন সিলেট অভিমুখে। সকাল ১০টার মধ্যে পৌছতে পারতেন সিলেট শহরে। অত:পর কোর্ট কাচারি সব সম্পন্ন করে আছরের নামাজের পর বাড়ী অভিমূখী হতেন। ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য সঙ্গেঁ থাকতো আহার সামগ্রী। বিশেষত বিরনী চালের ভাতের সাথে ভূণা মাংস কিংবা মাছ ভাজা দিয়ে সুপারি গাছের খোলের পুটলী তৈরী করে দিতেন গৃহিণীরা। তাছাড়া ভাঁজা চিড়ার সাথে গুড়ের পুটলীও বেঁধে দেওয়া হতো আলাদা ভাবে। পথিমধ্যে সময় এবং সুযোগ বুঝে পূর্ব পুরুষরা এগুলোর সদ্ব্যবহার করে মধ্যরাতে বাড়ী ফিরতেন। দূরের যাত্রায় খোদাপ্রদত্ত দুটি পা’ই ছিলো পথচারীদের প্রধান ভরসা। বর্ষা মৌসুমে নৌকা ছিলো অন্যতম বাহন। শুষ্ক মৌসুমে মাঠ কোণাকোণি পথ চিহ্ন পড়েযেতো পথিকদের পথযাত্রায়। দূর যাত্রায় আরেকটি বাহন ছিলো ঘোড়া। স্বচ্ছল পরিবারে গৃহপালিত গরুর সাথে ঘোড়াও পোষা হতো। দূর যাত্রার ক্ষেত্রে হাল আমলের মোটর সাইকেলের ভূমিকা রাখতো এই পোষা ঘোড়া। ঘোড়া চড়ে যে মেহমান কুটুম্ব বাড়ীতে যেতেন তার সামাজিক অবস্থান ছিলো অভিজাত তুল্য। অন্যদিকে ধান-চাল পরিবহনের জন্য অনেকে ঘোড়া ব্যবহার করতেন। একটি ঘোড়া ৩/৪ মণ ওজনের বস্তা বহনে ছিলো সক্ষম।
মহিলাদের যাতায়াত ব্যবস্থা ছিলো ভিন্নতর। পায়ে হেঁটে নিকটযাত্রার ক্ষেত্রে মহিলার বোরকা পরিধান ছিলো বাধ্যতামূলক, শুধু পুরুষের নজর এড়ানোর জন্য। দূর যাত্রার ক্ষেত্রে ছিলো পাল্কী। চার বেহারার পাল্কীতে মহিলাকে তুলে দিয়ে পাল্কীকে ঢেকে দেওয়া হতো চাঁদর দিয়ে। বর্ষা মৌসুমে ঘোমটি নৌকা ছিলো মহিলা পরিবহনের নির্ভরযোগ্য বাহন। ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে গ্রামীণ রাস্তাঘাটের অবকাঠামো দিয়ে রিক্সা চলাচল শুরু হয়েছিলো বিভিন্ন এলাকার। রিক্সারোহী মহিলার পর্দা বহাল রাখার জন্য দশহাতি কাপড় দিয়ে রিক্সার হুডকে পেছিয়ে দেয়া হতো মুরব্বিদের নির্দেশে।
(——–চলবে)
লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক