সরওয়ার আহমদ
আসন্ন একাদশ সংসদ নির্বাচনে দল এবং জোটে কেন্দ্রীক আধিপত্য কায়েমের লক্ষ্যে সিলেট বিভাগের ১৯টি সংসদীয় আসনে প্রতিদ্বন্ধি দুই জোটের মধ্যে চলছে প্রানান্ত তৎপরতা। গত নবম এবং দশম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ নেতৃত্বধীন মহাজোট সিলেট বিভাগের চারটি জেলাতেই একাধিপত্য কায়েমে সমর্থ হয়। এবারও সে ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে চলছে সাড়াঁশি তৎপরতা। অন্য দিকে হৃত অবস্থান পূনরুদ্ধারে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টও মরিয়া হয়ে উঠেছে। এ আলোকে তাদের তৎপরতা দৃশ্যমান। মহাজোট চাচ্ছে গত ২ নির্বাচনের ধারাবাহিকতা অনুসারে এবারও ১৯টি আসন ধরে রাখতে। পক্ষান্তরে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ১৯টি আসনের মধ্যে ০৯/১০টি আসন নির্বাচনী যুদ্ধের মাধ্যমে ছিনিয়ে আনতে কৃত সংকল্প। ফলে তামাবিল থেকে তেলিয়া পাড়া পর্যন্ত নির্বাচনী ঢেউ টালমাটাল অবায়ব ধারণ করেছে।
স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে সিলেটের গুরুত্ব অপরিসীম। পূণ্যভূমির কর্ণধার হযরত শাহ জালার (র) এর মাজার জিয়ারত এর মাধ্যমে স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু হয়। রাজনৈতিক মীথ আছে, সিলেট সদর আসনে যে দলের প্রার্থী জয়লাভ করে, সেই দল সরকার গঠন করে। তাই প্রতিটি দলই যাচাইবাছাই করে এই আসনে প্রার্থী মনোনয়ন দেয়। এবারও তার ব্যতিক্রম ধরেনি। তবে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে এবার উত্তরাধিকার প্রসংঙ্গটি সামনে চলে এসেছে। সদর আসনের দুই বারের এমপি ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবুল মুহিতের ছোট ভাই জাতিসংঘের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি ড. একে এম আবুল মোমেন কে আওয়ামীলীগের মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। তার বিপরীতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের তরফে বিএনপি দলীয় সাবেক এমপি প্রয়াত খন্দকার আব্দুল মালিকের পুত্র আব্দুল মুক্তাদিরকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। মর্যাদা পূর্ণ ওই আসনে অন্যান্যদলের প্রার্থী থাকলেও মূল প্রতিদ্বন্ধিতা হবে উক্ত ২ প্রার্থীর মধ্যে ঐক্যফ্রন্ট গত সিটি নির্বাচনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে খন্দকার মুক্তাদিরের বিজয় নিশ্চিত করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। অন্য দিকে সিটি নির্বাচনে আন্তঃ কোন্দল এবং ওভারকনফিডেন্ট জনিত পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে মহাজোট সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সিলেট-২ (ওসামনী নগর ও বিশ্বনাথ) আসনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মূল প্রার্থী নিখোঁজ ইলিয়াছ আলী পত্মী তাহসিনা রোশদির লুনার মনোনয়ন আদালত কর্তৃক বাতিল হওয়ায় এ আসনের নির্বাচনী হিসাব নিকাশ পাল্টে গেছে। লুনার জয় নিশ্চিত ছিল। কিন্তু মনোনয়ন বাতিল হওয়াতে এখানে ধানের শীষ আর নেই। একই ভাবে মহাজোটের পক্ষে জাতীয় পার্টির প্রার্থী থাকায় নৌকাও অনুপস্থিত। ফলে নির্বাচনী বাতাস বসেছে অন্য গতি নিয়ে। এই আসনে আওয়ামীলীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মুহিবুর রহমান স্বতন্ত্র প্রার্থী ড. এনামুল হক সরকার এবং খেলাফত মজলিসের প্রার্থী মুতাচ্ছির আলীর মধ্যে ত্রিমুখি লড়াই জমে উঠেছে। সিলেট-৩ (বালাগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ ও দক্ষিণ সুরমা) আসনে মহাজোট প্রার্থী ও বর্তমান এমপি মাহমুদুস সামাদ চৌধুরী ও বিএনপি প্রার্থী শফি আহমদ চৌধুরীর মধ্যে সরাসরি প্রতিদ্বন্ধিতা হচ্ছে। ইতি পূর্বে দুই প্রার্থী ৩বার ভোট যুদ্ধে অবতির্ণ হয়েছিলেন। প্রত্যেকেরই হার জিতের অভিজ্ঞতা আছে। এবার কে হারবে কে জিতবে তা নিয়ে কৌতুহল আছে বিভিন্ন মহলে। সিলেট-৪ (কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তা) আসনে মহাজোট প্রার্থী ও বর্তমান এমপি ইমরান আহমদ ও বিএনপি প্রার্থী দিলদার হোসেন সেলিমের মধ্যে নির্বাচনী লড়াই চৌকষ রূপ ধারণ করেছে। সিলেট-৫ (জকিগঞ্জ কানাইঘাট) আসনে মহাজোট প্রার্থী ও বর্তমান এমপি হাফিজ আহমদ মজুমদারের সাথে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষে জমিয়তে উলামার প্রার্থী মাওলানা ওবায়দুল্লা ফারুকের মধ্যে সরাসরি প্রতিদ্বন্ধিতা হচ্ছে। সিলেট-৬ (গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার) আসনে বর্তমান এমপি ও শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সাথে বিএনপির নতুন প্রার্থী ফয়ছল আহমদ চৌধুরীর হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। দলীয় কর্মীদের একাংশের ক্ষোভ এবং জনসংযোগে ঘাপলা থাকায় নুরুল ইসলাম নাহিদ কিছুটা বিপাকে আছেন।
সুনামগঞ্জ
জেলার ৫টি আসনেই সরাসরি প্রতিদ্বন্ধিতার চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সুনামগঞ্জ-১ (ধর্মপাশা, তাহিরপুর ও জামালগঞ্জ) আসনে আওয়ামীলীগ প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য মোয়াজ্জিম হোসেন রতন এবং বিএনপির সাবেক এমপি নাজির হোসেনের মধ্যে সরাসরি প্রতিদ্বন্ধিতা হচ্ছে। সুনামগঞ্জ-২ (দিরাই ও শাল্লা) আসনে সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত সুরেঞ্জিত সেন গুপ্তের স্ত্রী জয়া সেন গুপ্তার সঙ্গে হেভিওয়েট প্রার্থী ও সাবেক এমপি নাসির উদ্দিনের প্রতিদ্বন্ধিতা হচ্ছে। গত ১৯৯৬ইং নির্বাচনে বর্তমান বিএনপি নেতা নাসির উদ্দিন চৌধুরী তৎকালে জাপার টিকেটে প্রতিদ্বন্ধিতা করে সুরঞ্জিত সেন গুপ্তকে পরাজিত করেছিলেন। এই আসনে দুই হেভিওয়েট প্রার্থীর লড়াইয়ে কে হারবে কে জিতবে তা নিয়ে কৌতুহল আছে। সুনামগঞ্জ-৩ (জগন্নাতপুর ও দক্ষিণ সুনামগঞ্জ) আসনে আওয়ামীলীগ এমপি ও বর্তমান অর্থ প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মন্নানের সাথে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষে জমিয়তে উলামার প্রার্থী ও সাবেক এমপি শাহিনুর পাশার প্রতিদ্বদ্ধিতা হচ্ছে। এখানে সংহত অবস্থানে আছেন আব্দুল মন্নান। সুনামগঞ্জ-৪ (বিশ্বম্বরপুর ও সদর) আসনে নবীন প্রবীণের লড়াই জমে উঠেছে। মহাজোটের পক্ষে জাতীয় পার্টির বর্তমান এমপি পীর মিছবাহুর রহমান ও বিএনপির প্রার্থী ও সাবেক হুইপ ফজলুল হক আসপিয়ার তীব্র প্রতিদ্বন্ধিতা হচ্ছে। সুনামগঞ্জ-৫ (ছাতক ও দোয়ারা বাজার) আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য ও আওয়ামীলীগ প্রার্থী মুহিবুর রহমান মানিক ও বিএনপির নতুন মুখ প্রার্থী মিজানুর রহমান এর মধ্যে ভোটের লড়াই জমে উঠেছে।
হবিগঞ্জ
পূর্বাঞ্চলের আওয়ামীলীগ অধ্যূষিত গোপালগঞ্জ বলে খ্যাত হবিগঞ্জ জেলার ৪টি আসনে নির্বাচনী আবহ জমজমাট আকার ধারণ করেছে বৈচিত্রতা নিয়ে। ৪টি আসনেই সরাসরি প্রতিদ্বন্ধিতা হচ্ছে মহাজোট ও ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থীদের মধ্যে। হবিগঞ্জ-১ (নবীগঞ্জ-বাহুবল) আসনটি স্থানীয় ভাষায় “বেতালা” বলে খ্যাত। ৭০ সনের নির্বাচনে নৌকার জয়জয়কার থাকলেও এআসনে হাতি মার্কা নিয়ে প্রাদেশিক পরিষদে জয়লাভ করেছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী। বর্তমানে ওই আসনে সরাসরি প্রতিদ্বন্ধিতা হচ্ছে প্রয়াত ২ মন্ত্রী পুত্রের মধ্যে। বঙ্গবন্ধু মন্ত্রি সভার সদস্য মরহুম দেওয়ান ফরিদ গাজির পুত্র মোহাম্মদ শাহ নেওয়াজ ওরফে মিল্লাদ গাজী প্রতিদ্বন্ধিতা করছেন আওয়ামীলীগের টিকেট নিয়ে। অন্যদিকে ৯৬ সনের শেখ হাসিনা মন্ত্রী সভার অর্থমন্ত্রী প্রয়াত এ এম এস কিবরিয়া পুত্র রেজা কিবরীয়া জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের তরফে গণফোরামের টিকেট নিয়ে নির্বাচনী মাঠে নেমেছেন। নবীগঞ্জে উভয় প্রার্থী সমান সমান অবস্থায় রয়েছেন। এখানে জয় পরাজয় নির্ভর করছে বাহুবলের উপর। হবিগঞ্জ-২ (বানিয়াচং-আজমিরিগঞ্জ) আসনে মহাজোট তথা আওয়ামীলীগের বর্তমান এমপি আব্দুল মজিদ খান এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষে খেলাফত মজলিসের মাওলানা আব্দুল বাছিত প্রার্থী হয়েছেন। এ আসনে আব্দুল মজিদ খানের অবস্থান সংহত। হবিগঞ্জ-৩ (সদর-লাখাই) আসনে আওয়ামীলীগের বর্তমান এমপি এডভোকেট আবু জাহির এবং বিএনপি প্রার্থী হবিগঞ্জ পৌর মেয়র জিকে গৌছ এর মধ্যে সরাসরি প্রতিদ্বন্ধিতা হচ্ছে। হবিগঞ্জ সদরে জিকে গৌছ সংহত অবস্থানে রয়েছেন। অন্য দিকে লাখাই উপজেলাতে আবু জাহির শক্ত অবস্থানে আছেন। হবিগঞ্জ-৪ (মাধবপুর-চুনারোঘাট) আসনে আওয়ামীলীগের বর্তমান এমপি মাহবুব আলী এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষে খেলাফত মজলিজের আহমদ আব্দুল বাছিতের সরাসরি প্রতিদ্বন্ধিতা হচ্ছে। এ আসনে মাহবুব আলীর অবস্থান সংহত।
মৌলভীবাজার
জেলাতে ৪টি সংসদীয় আসনের মধ্যে মৌলভীবাজার-১ (বড়লেখা-জুড়ি) আসনে আওয়ামীলীগের বর্তমান হুইপ মোঃ শাহাব উদ্দিন প্রতিদ্বন্ধিতা করছেন। তার বিপরীতে রয়েছেন বিএনপির নবীন প্রার্থী নাসির উদ্দিন মিঠু। দুই জনের মধ্যে প্রতিদ্বন্ধিতা হলেও শাহাব উদ্দিনের অবস্থান সংহত বলে প্রতীয়মান। মৌলভীবাজার-২ (কুলাউড়া) আসনটি বিচিত্র এবং আবেগি বলে খ্যাত। অতীতে এ আসন থেকে আওয়ামীলীগ, মুসলিমলীগ, জাপা এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছেন। ভোটের জোয়ার এখানে উঠানামা করে মেজাজ নির্ভর হয়ে। আাসন্ন সংসদ নির্বাচনে বিকল্প ধারার প্রার্থী ও সাবেক এমপি এম এম শাহীন ভোটে নেমেছেন নৌকা প্রতীক নিয়ে। তার বিপরীতে ৯৬ সনে নৌকা প্রতীক নিয়ে বিজয়ী এমপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর এবার ভোট যুদ্ধে নেমেছেন ধানের শীষ নিয়ে। তিনি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী। এই দুই প্রার্থীর প্রতীক বদল নিয়ে যেমনি তেলেছমাত আছে তেমনি ফলাফল নিয়েও বাজিমাৎ অপেক্ষা করছে। মৌলভীবাজার-৩ (সদর-রাজনগর) আসনে জেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি নেছার আহমদ এবং বিএনপির জেলা সভাপতি ও সাবেক এমপি নাসের রহমানের মধ্যে সরাসরি প্রতিদ্বন্ধিতা হচ্ছে। নাসের রহমান প্রয়াত অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের পুত্র বিধায় তার একটি বাড়তি সুবিধা আছে। অন্য দিকে নেছার আহমদ এর পিছনে আছে সাংগঠনিক শক্তি। মৌলভীবাজার-৪ (শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ) আসনে অতীতের ৩ নির্বাচনের মতো এবারও আওয়ামীলীগরে সাবেক চীফ হুইফ উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহিদ এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা হাজি মুজিব এ আসনে মুখামোখি হচ্ছেন। চা শ্রমিক এবং সংখ্যালঘু অধ্যূষিত এ আসনে গত ৫টি নির্বাচনে উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহিদ অনায়াসে জয় লাভ করলেও এবার তাকে ঘাম ঝরাতে হচ্ছে। প্রতিদ্বন্ধি হাজি মুজিব কমলগঞ্জে সংহত আবস্থানে রয়েছেন। অন্য দিকে শ্রীমঙ্গলে উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহিদের রয়েছে শক্ত অবস্থান।
অতীতের ১০টি সংসদ নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষনে দেখা যায় ৪টি নির্বাচন ব্যতীত বাকী ৬টি নির্বাচনে সিলেট বিভাগের ১৯টি আসনে আওয়ামীলীগের আধিপত্য ছিল। এবারও তার ব্যতিক্রম হবেনা। বিভিন্ন সংস্থার জরিপের আলোক ১৯টি আসনের মধ্যে এ পর্যন্ত ১১টি আসনে মহাজোটের প্রার্থীরা এগিয়ে। ৪ জেলার দুটি করে ৮টি আসন চরম প্রতিদ্বন্ধিতার আলোকে ঝুঁকি পূর্ণ হয়ে উঠেছে। ঝুঁকিপূর্ণ এই ৮টি আসন থেকে ৪জন প্রার্থী বেরিয়ে আসতে পারবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে মহাজোটের যোগফলে দাড়াবে ১৫টি আসন। বাকী ৪টি আসন হস্তগত হবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের।
সরওয়ার আহমদ, সাংবাদিক ও কলামিষ্ট।