স্টাফ রিপোর্টার:
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এক দশক পর মৌলভীবাজার জেলা বিএনপি’র বিভক্তির অবসান হয়েছে। এখন মৌলভীবাজার জেলা বিএনপি’র নেতাকর্মীরা ধানের শীষ প্রতীককে বিজয়ী করতে একতাবদ্ধ। এ উপলক্ষে বিভক্ত নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে শুক্রবার রাতে সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী মরহুম এম সাইফুর রহমানের মামাতো ভাই বদরুল আলমের বাসায় এক নৈশ ভোজের আয়োজন করা হয়। নৈশ ভোজে বিভক্ত দুটি গ্রুপের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
নৈশভোজে উপস্থিত জেলার একাধিক নেতা জানান, ব্যক্তি ফ্যাক্ট নয়। নেত্রীর নির্দেশে ধানের শীষকে বিজয়ী করার জন্য আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছি। ১০ বছরের সকল ভুল বুঝাবুজির অবসান হয়েছে। এখন আমরা কাঁদে কাঁদ মিলিয়ে কাজ করতে চাই। এ খবর শুনে আনন্দিত পুরো জেলার তৃণমূলের নেতাকর্মী। দলের সিনিয়র নেতারা জানান, এম সাইফুর রহমান ছিলেন পুরো সিলেট বিভাগের বিএনপির অভিভাবক। উনি জীবিত থাকা অবস্থায় নেতাদের মধ্যে পদ-পদবি নিয়ে ক্ষোভ থাকলেও কোন্দল করার সাহস দেখাননি কেউ।
জানা যায়, এক দশক ধরে জেলা সভাপতি ও সম্পাদক দুটি বলয়ে পরিচালনা করছিলেন দলীয় কার্যক্রম। যার কারণে ভেঙ্গে পড়েছিল পুরো দলের ও অঙ্গ সংগঠনের সাংগঠনিক কাঠামো। এ সময়ের মধ্যে জেলার ৭টি উপজেলা, ৫টি পৌরসভা ও ৬৭টি ইউনিয়নে পাল্টা-পাল্টি কমিটি করছেন তারা। এ নিয়ে তৃণমূল নেতকর্মীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল। যার কারণে অনেক নেতাকর্র্মীরা সরকার বিরোধী আন্দোলনে না গিয়ে নিজেদের গ্রুপিং নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন।
দলের এই ক্লান্তিলগ্নে ও সংকটপূর্ণ সময়ে দেশের অন্যান্য জেলার ন্যায় কোন গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারেননি বিভক্ত মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা। দলের অস্তিত্ত্ব রক্ষার লড়াইয়ে অন্যান্য জেলা হরতাল, অবরোধ, মিছিল ও সমাবেশসহ কেন্দ্রের দেয়া সকল কর্মসূচি স্বতস্ফূর্ত ভাবে পালন করলেও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে ছিল মৌলভীবাজার। এ নিয়ে দলের তৃণমূলের ত্যাগি নেতাকর্মীদের সাথে অন্তরদ্বন্ধ দেখা দেয় পদ লোভীদের। অনেক নেতাকর্মী দীর্ঘ দিন নিস্ক্রিয় থাকার পর অন্য রাজনীতির সাথে সম্পৃত্ত হয়েছেন। আবার কেউ কেউ রাজনীতি ছেড়ে অন্য পেশায়ও সম্পৃক্ত হয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিভক্তির কারণে বিগত স্থানীয় নির্বাচন গুলোতেও ভালো ফলাফল করতে পারেনি সাবেক ক্ষমতাশীন দল। ২০১১ সালে পৌর নির্বাচনে জেলার সবকটি পৌরসভায় বিএনপির প্রার্থীরা বিজয়ী হলেও গত পৌর নির্বাচনে একটিতেও বিজয়ের মুখ দেখতে পারেনি তারা। বিগত উপজেলা নির্বাচনে সদর উপজেলায় জেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান ছাড়া আর কেউই এ জেলায় নির্বাচিত হতে পারেননি। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর ও ওয়ার্ড পর্যায়েও দলটির এমন বেহাল অবস্থা।
দলীয় সূত্র আরো জানায়, কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের জন্য এম নাসের রহমানকে জেলা সভাপতি ও খালেদা রাব্বানীকে সাধারণ সম্পাদক এবং আবদুল মুকিতকে প্রথম যুগ্ম-সম্পাদক করে ২০০৯ সালে একটি আংশিক কমিটি ঘোষণা করেন প্রয়াত মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেন। একই ভাবে জেলার সাত উপজেলা এবং পাঁচ পৌরসভায় উভয় পক্ষের লোকজন নিয়ে কাউন্সিল করার জন্য আংশিক কমিটি ঘোষণা করেছিলেন তিনি। কিন্তু ২০০৯ সালের জাতীয় কাউন্সিল থেকে ফিরেই আলাদা আলাদা দলীয় কার্যক্রম শুরু করেন জেলার এই দুই শীর্ষ নেতা। এদিকে ২০১৭ সালের ২৬ মে এম নাসের রহমানকে সভাপতি ও মিজানুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক করে কেন্দ্র ৪৮ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি ঘোষণা দেয়। কিন্তু সভাপতি সাধারণ সম্পাদককে মেনে নিতে পারেননি। একজন অপরজনের বিরোদ্ধে রাজপথে মিছিল ও সমাবেশ করেছেন।
দীর্ঘ দিনের মেরুকরণ নিষ্পত্তির জন্য বিএনপির চেয়ারপার্স সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশে গত ২০১৬ সালের ৩ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ন-মহাসবি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ও শাখাওয়াত হোসেন জীবন এর নেতৃত্বে একটি টিম পৃথক পৃথক ভাবে দু-গ্রুপের নেতাকর্মীদের সাথে মতবিনিময় করেন। উপস্থিত নেতকার্মীদের খোলামেলা মতামত নিয়েছেন। ইতি পূর্বে সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম মহাসচিব মো. শাহজাহান সমোঝতার জন্য মৌলভীবাজার সফর করেছেন। কিন্তু কেন্দ্রের কোনো চেষ্টাই এখানে সফল হয়নি। এমনকি ২০১৪ সালে এ বিষয়ে ডাকা একটি সভায় কেন্দ্রের নেতাদের আনা হয়। কিন্তু এক পর্যায়ে শহরের হাসপাতাল রোডে দুই পক্ষের ভয়াবহ সংঘর্ষে ৪০-৫০ জনের মতো কর্মী আহত হয়েছিলেন। সর্বশেষ গত ৮ এপ্রিল কেন্দ্রীয় নেতা আমান উল্লাহ আমান এর নেতৃত্বে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি দল মৌলভীবাজার আসেন। স্থানীয় একটি অভিজাত রেষ্টুরেন্টে উভয় গ্রুপের নেতাকর্মীদের নিয়ে সভা করে বিবেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহবান করেন। কিন্তু কেন্দ্রের কমান্ড মানেননি জেলার নেতৃবৃন্দ।
বিভক্তির অবসানের খবর শুনে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সাথে কথা হলে তারা বলেন, দীর্ঘ দিন পর আমাদের জেলা নেতৃবৃন্দের শুভ বৃদ্ধির উদয় হয়েছে। এভাবে পুরো জেলায় ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করলে ধানের শীষের বিজয় সুনিশ্চিত।
এবিষয়ে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, আমরা অতিতের সকল ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখন আমাদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। ব্যক্তি নয়, ধানের শীষ প্রতীককেই বিজয়ী করা এবং দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি করতে চাই।