মানবাধিকার কর্মী সুলতানা নাসরিন:
মৌলভীবাজার জেলায় সংবাদ প্রকাশের জের ধরে বিগত ৫ বছরে ৯ জন সাংবাদিক নির্যাতিত হয়ে আজও আত্মগোপনে রয়েছেন। জানা যায় আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসনের সময় বিভিন্ন সন্ত্রাস বিরোধী এবং মাদকদ্রব্য সহ বিভিন্ন গডফাদারদের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের জের ধরে সাংবাদিকরা তাদের জীবনের নিরাপত্তা হারিয়ে আজও আত্মগোপনে রয়েছেন।
জাতির বিবেক সাংবাদিকরা তাদের পরিবার পরিজন ছেড়ে আজ নির্বাসিত। গ্রেফতার ও হামলার ভয়ে তারা পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করতে পারছেন না। অনেকটা বলতে গেলে তারা মানবতর জীবন যাপন করছেন। বিভিন্ন তথ্য ও অনুসন্ধানের ভিত্তিতে জানা যায় মৌলভীবাজার জেলায় বিগত ৫ বছরে আওয়ামী লীগের শাসনামলে ৯ জন সাংবাদিক নির্যাতিত হয়েছেন। অনেকেই তাদের নিজ শেষ সম্বল হারিয়েও এক অমানবিক নির্যাতিত জীবন যাপন করছেন। দীর্ঘদিন ধরে তারা রয়েছেন আত্মগোপনে। পরিবারের সাথে যোগাযোগ করলে অনেকেই বলেন তাদের কোন খোঁজ খবর পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকের পরিবার যেন অন্ধকারে ঢেকে গেছে, স্বজনদের চোখে মুখে শান্তির কোন ছোঁয়া নেই যেন অসহায় অমানবিক এক জীবন বেদনার নিষ্ঠুর করুন কাহিনী। আমরা প্রত্যাশা করি সাংবাদিকরা জাতির বিবেক তারা যেন সমাজে স্বাভাবিকভাবে জীবন যাপনে ও নিরাপত্তা প্রদান যেন নিশ্চিত করা হয়। নিম্নে সাংবাদিকদের পরিচয় ও নির্যাতনের চিত্র তোলে ধরা হল।
১। মতিউর রহমান দৈনিক ভোরের ডাক পত্রিকার শ্রীমঙ্গল প্রতিনিধি: সংবাদ প্রকাশের জের ধরে গত ২১/০১/২০২০ইং তারিখে রাত ৮.৪৫ মিনিটে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তার উপর অতর্কিত হামলা করে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে এতে তিনি গুরুত্বর আহত হলে স্থানীয়রা উদ্ধার করে শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন। ১০ দিন চিকিৎসা শেষে তিনি বাড়ি ফিরেন। তারপর তথ্যপ্রযুক্তি আইনের আওতায় ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ২৭ দিন কারাবরণ করেন।
২। জাবেল মিয়া দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার মৌলভীবাজার সদর প্রতিনিধি হিসেবে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করছেন। সরকারি কর্মকর্তা ও আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের অনিয়ম নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন করেন। যার প্রেক্ষিতে আওয়ামীলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা তার উপর হামলা করার জন্য পরিকল্পনা করেন। একাধিকবার চেষ্টা করে গত ২৫/০৯/২০২০ইং তারিখ রাত ৯টায় বাড়ি ফেরার পথে শমশেরনগর রোডের শ্যামলী রাস্তার মুখে হামলা করা হয়। মুখে ও মাথায় গুরুত্বর আঘাত প্রাপ্ত হন।
৩। রহিম উদ্দীন দৈনিক সমকাল পত্রিকার কমলগঞ্জ প্রতিনিধি থাকাকালিন সময়ে ১৭/০১/২০২১ইং তারিখে এমপি আব্দুস শহিদ এর অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেন রহিম উদ্দিন। এ প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ায় সমালোচিত হন এমপি আব্দুস শহিদ। তাই তিনি রহিম উদ্দীন এর পিছনে তার সন্ত্রাসী বাহিনী লাগিয়ে দেন। ২৫/০১/২০২১ইং তারিখ রাতে আদমপুর বাজারে রহিম উদ্দীন এর উপর অতর্কিত হামলা করে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার ডান হাতের একটি আঙ্গুল কেটে ফেলে। প্রতিহিংসার জের ধরে সাংবদিক রহিম উদ্দীনকে গত ০৩/০৩/২০২১ ইং একটি মিথ্যা হত্যা মামলার চার্জশিট অন্তর্ভুক্ত আসামি করা হয়। এরপর থেকে তিনি এখন পর্যন্ত আত্মগোপনে রয়েছেন।
৪। সাপ্তাহিক মানব ঠিকানার জুড়ী প্রতিনিধি, সাংবাদিক মো এমরান আহমেদ গত ১৫/১১/২০২২ইং সন্ত্রাসীরা দোকানে এসে প্রকাশ্য হামলা চালিয়ে প্রাণনাশের চেষ্টা করলে ঘটনাস্থলে তিনি গুরুতর আহত অবস্থায় পালিয়ে গিয়ে প্রাণে বেঁচে যান। এরপর থেকে তিনি আজও আত্মগোপনে রয়েছেন। জানা যায় তিনি আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য চোরাচালানি সহ বেশ কিছু সংবাদ প্রকাশ করেছিলেন। সন্ত্রাসীরা ক্ষিপ্ত হয়ে পর্যায়ক্রমে ৩টি মিথ্যা মামলা দায়ের করে এবং ইতিমধ্যে ২টি মামলার রায় ঘোষণা হয়েছে। তিনি বর্তমানে সাজাপ্রাপ্ত আসামী। এমনকি সন্ত্রাসীদের ভয়ে উনার পরিবারের মা ও বোন বাড়িতে অবস্থান করতে পারছেন না। তারা অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন।
৫। সামাদ খান সাপ্তাহিক পাঁতাকুড়ির দেশ পত্রিকার বড়লেখা প্রতিনিধি হিসেবে দীর্ঘ দিন যাবত কাজ করছেন। বড়লেখায় পরিবারতন্ত্র ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েক করেন বন, পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রী মো: শাহাব উদ্দিন। তার ভাগনাদের আধিপত্যে কেউ এলাকায় বসবাস করতে পারছেন না। তাদের জুলুম ও নির্যাতনের চিত্র নিয়ে পাঁতাকুড়ি পত্রিকায় প্রতিবেদন করেন সামাদ খান। যার প্রেক্ষিতে মন্ত্রীর ভাগনা জুয়েল সাংবাদিককে হত্যা করার জন্য খোঁজতে থাকেন। ২৯/০১/২০২৩ইং তারিখে তার উপর অতর্কিত হামলা করেন। সাংবাদিক সামাদ খান গুরুত্বর আহত হলে তার স্বজনরা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন।
৬। সুরমান মিয়া সাপ্তাহিক মনু বার্তা পত্রিকার রাজনগর প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করাকালীন সময়ে ২০/০৩/২০২৩ইং তারিখে উপজেলা চেয়ারম্যান শাহজাহান খানের অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন করেন। এই প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে শাহজাহান খান ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাসীদের দিয়ে সাংবাদিক সুরমান মিয়া উপর হামলা চালান।
৭। মো: আব্দুল কাদির সাপ্তাহিক পূর্বদিক পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার হিসাবে কাজ করাকালিন সময়ে মনুনদীর বরাদ্দের এক হাজার কোটি টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রতিবেদন করেন। নিউজ এর প্রেক্ষিতে দুদক তদন্ত করে দুর্নীতি প্রমাণিত হওয়ায় মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক মিছবাহুর রহমান এর জরিমানা হয়। এনিয়ে ক্ষেপে যান মিছবাহুর রহমান। ২৬ মে ২০২৩ইং তারিখ রাতে আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা সাংবাদিক মো: আব্দুল কাদির এর উপর অতর্কিত হামলা করে এবং দেশীয় অস্ত্রের আঘাতে হাতে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুরুত্বর জখম হয়। স্থানীয়রা সাংবাদিক মো: আব্দুল কাদিরকে উদ্ধার করে মৌলভীবাজার নূরজাহান প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করেন। এক পর্যায়ে তিনি দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
৮। আবিদ হোসেন সাপ্তাহিক সোনালী খবর পত্রিকার রাজনগর প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামীলীগের মনোনয়ন প্রত্যাশি মো: জিল্লুর রহমান এর পিতা রাজাকার ছিলেন এ বিষয় গুলো উল্লেখ করে জিল্লুর রহমান এর বিরুদ্ধে ২১/১২/২০২৩ইং তারিখে সংবাদ করেন সাংবাদিক আবিদ হোসেন। এই সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পরই জ্বলে উঠেন মো: জিল্লুর রহমান। পরবর্তীতে তিনি পুলিশ দিয়ে ধরে নিয়ে সাংবাদিক আবিদ হোসেনকে মারধর করান। সাংবাদিক কয়েকদিন জেলও কাটেন।
৯। বেলাল খন্দকার সাপ্তাহিক আমার সংবাদ পত্রিকার জুড়ী উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন। ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন এর একক আধিপত্য ছিল জুড়িতে। এনিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেন সাংবাদিক বেলাল খন্দকার। ০৫/০৬/২০২৪ইং তারিখে সংবাদ প্রকাশিত হলে সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা সাংবাদিক বেলাল খন্দকারকে হত্যা করার জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠেন। সংবাদ প্রকাশের দুই দিন পরই ছাত্রলীগের লালিত সন্ত্রীরা বেলাল খন্দকারকে মারধর করেন এবং ভবিষ্যতে কোন দিন তাদের বিরুদ্ধে কোন ধরনের সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশ না করার জন্য প্রাণনাশের হুমকি প্রদান করে।
আওয়ামী লীগ শাসনামলের সর্বশেষ ৫ বছরে মৌলভীবাজারে সংবাদ প্রকাশের জের ধরে ৯ জন সাংবাদিক নির্যাতনের স্বীকার





















