মোহাম্মদ আবু তাহের
পহেলা মে বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন-সংগ্রাম অনুপ্রেরণা ও আলোকবর্তিকার দিন হিসেবে স্বীকৃত| ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমের উপযুক্ত মূল্য ও দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর পুলিশ গুলি চালালে অনেক শ্রমিক হতাহত হন|তাদের আত্মত্যাগের কারনেই দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের সময়সীমা আজ সারা পৃথিবীতে স্বীকৃত|মহান মে দিবস পৃথিবীর সকল শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন | ঐতিহাসিক এই দিনটি তাদের মর্যাদা সমুন্নত করেছে | শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলনে যুগে যুগে যারা আত্মাহুতি দিয়েছেন তাদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই|মে দিবস প্রতিবছর শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও উন্নত জীবনযাপনের প্রত্যয় নিয়ে আসে | বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণীর পাশাপাশি বাংলাদেশের শ্রমিকরা ও অতীতের সংগ্রামী স্মৃতি ধারণ করে সকল প্রকার নির্যাতন থেকে মুক্তির জন্য মে দিবস পালন করে থাকে | কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হল শিকাগোর শ্রমিকেরা যে দাবিতে রাজপথে নেমেছিল সে দাবি এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি | এখনো শ্রমিকেরা অনেক মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত | বন্ধ হয়নি শিশুশ্রম| বন্ধ হয়নি শিশু শ্রমিক নির্যাতন | দেশের স্বার্থে শিশু ও শ্রমিক নির্যাতন বন্ধ করা প্রয়োজন|
সুকান্ত তার ছাড়পত্রের লিখেছিলেন –
চলে যাব তবু ও যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ,
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল
এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে
যাব আমি
নবজাতকের কাছে এই আমার দৃঢ় অঙ্গীকার|মানুষের নিষ্ঠুরতা সমাজের অবিচার আর অবক্ষয় সুকান্ত তার কবিতায় বলে গেছেন | সুকান্ত শোষনহীন বঞ্চনাহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি | তার স্বপ্ন এখনো পূরণ হয়নি | এখনো ফেসবুকে গৃহকর্ত্রীর শিশু নির্যাতন দেখলে গা শিউরে উঠে| মাঝেমধ্যে ফেসবুকে দেখা যায় পাঁচ-ছয় বছরের গৃহকর্মী শিশুকে যে নিষ্ঠুর নির্যাতন করা হয় তা রীতিমত অকল্পনীয় অবিশ্বাস্য |দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের হতভাগ্য শিশুদের | বাংলাদেশের অতি দরিদ্র ঘরের শিশুরা চরম অসহায়| তারা নির্যাতনের সহজ শিকার | তারা অমানবিকভাবে কাজের ছেলে, কাজের মেয়ে হিসেবে সারাদিন পরিশ্রম করে |বিশ্রামহীন, ক্লান্তিহীন নিদ্রাহীন তাদের জীবন | কাজের ছেলে কাজের মেয়েদের নির্যাতন দেখলে মনে হয় নির্যাতনকারীরা আইনের উর্ধ্বে | শুধু গৃহকর্মীই নয় দেশের যেকোন শিশু শ্রমিককে নির্যাতন যেন স্বাভাবিক ব্যাপার | ঢাকাসহ সারা দেশের শহর ও নগরবাসীর জীবনকে স্বস্তিদায়ক করছে শিশুশ্রম| বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গৃহভৃত্যরাই শিশুভৃত্য | এটাই বাংলাদেশের বাস্তব চিত্র | কলকারখানায় নানারকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ও শিশু শ্রমিকরা জড়িত | আন্তর্জাতিক আইন ও দেশের আইনে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ| বাংলাদেশে এখনও অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে, তাদের সকলের সন্তানদের হয়তো একসাথে শিশুশ্রম থেকে বাহিরে রাখা সম্ভব হবে না | কিন্তু এসমস্ত শিশুদের নির্যাতনের হাত থেকে অবশ্যই মুক্ত করতে হবে | মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে একটা শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে | মুক্তিযুদ্ধের একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় গান ছিল একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে আমরা যুদ্ধ করি | শিশুদের অত্যাচার-নির্যাতন থেকে বাঁচতে হলে মে দিবসের চেতনাকে ধারণ করে সামাজিক আন্দোলন করতে হবে| যে সমস্ত মানুষরূপী জানোয়ারদের ফেসবুকে শিশুদের নির্যাতন করতে দেখা যায় তাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো দরকার | শিশুশ্রম একটি মারাত্মক সমস্যা | এটি বিশ্বের সর্বত্রই কমবেশি বিরাজমান, তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শিশু শ্রম অত্যন্ত বেশি | বাংলাদেশের শিশু শ্রমের উল্লেখযোগ্য কারণ সমূহ হলো চরম দারিদ্র / অজ্ঞতা / শিক্ষার অভাব / শিক্ষার খরচ যোগানোর অক্ষমতা / ভাসমান ও গৃহহীন জনসংখ্যা ইত্যাদি | যুগ যুগ ধরে গৃহকর্মীরা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন | গণমাধ্যমে দীর্ঘকাল ধরে গৃহকর্মী নির্যাতনের হৃদয়বিদারক কাহিনী ছাপা হচ্ছে | সরকার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার একটি কনভেনশনের আলোকে গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতিমালা প্রণয়ন করে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন | গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতিমালা নাগরিক কর্তব্যবোধকে শানিত করবে বলে আশা করি|
আমাদের জাতীয় কবি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম অত্যাচারী মানুষদের সরাসরি আঘাত করেছেন|তার একটি কবিতার পংক্তিমালা দিয়ে লেখা শেষ করছি-
দেখিনু সেদিন রেলে
কুলি বলে এক বাবু সাব তারে
ঠেলে দিল নীচে ফেলে
চোখ ফেটে এল জল
এমন করে কি জগত জুড়িয়া
মার খাবে দুর্বল |
শ্রমিক সমাজ মানব সত্ত্বা নিয়ে বেঁচে থাকুক মে দিবসে এই হোক আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার |
লেখকঃ কলামিস্ট, ব্যাংকার ও গবেষক