সরওয়ার আহমদঃ
গ্রামীণ খাল বা বয়েচলা ছোট নদীতে ভাদ্রমাস থেকেই মাছের প্রাচুর্য্য পরিলক্ষিত হতো। তখন ভাসান পানি ক্রম্বান্ময়ে নিঃসৃত হত খালে বা নদীতে। তাই ভাটার টানে ভাসান এলাকার মাছও নেমে আসতো নদীতে। নদীতীরে তখন রাত দিন মাছ ধরার প্রবণতা একপ্রকার উৎসবের অবয়ব নিতো সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীদের মধ্যে। ভাদ্র শেষে আশ্বিন মাসে ¯্রােতস্বিনী নদীগুলোতে “লাছ” মাছের উজাই ছিলো ভিন্নমাত্রায়। চন্দ্রকলার সাথে সম্পর্ক রেখে ঝাঁকে ঝাঁকে “লাছ” মাছ উজান অভিমুখী হয় বল জনশ্রুতি আছে। নদী তীরবর্তী মাছ শিকারীরা মাছ উজাইয়ের সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় থাকতেন। উজানমুখী “লাছ” মাছ তার উজানগতি ধরে রাখতে মাঝে মধ্যেই লাফদেয়। মাছের এই লম্ফঝম্ফ আঁচ করে শিকারীরা “উড়াল জাল” দিয়ে মাছ ধরতে শুরু করেন। বর্তমানে “লাছ” মাছের এই উজান যাত্রা কিছুটা কমে এসেছে। কিশোর বয়সে মনুনদীতে “লাছ” মাছের উজাই এবং মাছ শিকার প্রত্যক্ষ করেছি। দক্ষ শিকারীরা উড়াল জালের এক ক্ষেপে ৭/৮ কেজি লাছ মাছ ধরা পড়েছে কখনও। কোথাও কোথাও জাল ক্ষেপন শেষে টেনে তোলার সময় মাছ শিকারী নদীতে পড়ে যাওয়ার কথাও শোনাযেত। অত:পর লাশ ভেসে উঠতো ভাটিতে। এমতাবস্থায় জনান্তিকে খবর রটনা হতো, মাছের সঙ্গীয় “বাইরকা” বা “খুত” মাছ শিকারীকে নাকি নদীতে টেনে নিয়েছে। তারপরও নদী তীরে মাছ ধরার উৎসবে কোন কমতি থাকতো না।
মাছ শিকার বা মাছমারা ছিলো সাংবাৎসরিক ব্যাপার। গ্রাম জনপদে কার্তিক মাস থেকেই শুরু হতো নালা সেঁচ, খাল সেঁচ ও বিলের “খাঞ্জা” সেঁচ প্রক্রিয়া। এটি অব্যাহত থাকতো ফাল্গুন চৈত্র মাস পর্যন্ত। পৌষ মাসে বিরণী চালের ভাতের সাথে বিলের বা নদীর কৈ, মাগুর মাছের ভাঁজা ছিলো বনেদী পরিবারের উপাদেয় সকালের নাস্তা। হাওর কিনারের গ্রামগুলোতে মাছের প্রাচুর্য্য ছিলো সব ঋতুতে। তবে অগ্রাহায়ন মাস থেকেই বিলের মাছের ঘনত্ব বা প্রাচুর্য্য দেখা যেতো বেশী মাত্রায়। সব অঙ্গঁণের পানি নিঃসৃত হয়ে ঠাঁই নেয় বিলে বা হাওড়ে। হাওড়ের লীজকৃত বিল সমুহের ইজারাদাররা তখন বিলগুলোতে প্রহরী নিয়োগ করতো যাতে বহিরাগত কেউ বিলে মাছ না মারে। রাতে নৌকার গুলুইয়ো লণ্টন বেঁধে প্রহরীরা আওয়াজ তুলতো-খবরদার। কিন্তু এই খবরদার ধ্বনিকে উপেক্ষা করেও সাহসী জেলেরা রাতে মাছধরতো পেঁটের ধান্ধায়। পরদিন প্রত্যুষে ধৃত মাছ নিয়ে এই সুযোগসন্ধানীরা মাছ ফেরীতে নেমে পড়তো গ্রামে গ্রামে। নগদ অর্থের পাশাপাশি ধান বা চাউলের বিনিময়ে তারা মাছ বিক্রি করে বাড়ী ফিরতো।
(——–চলবে)
লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক
পর্ব-১০ দিন গুলো মোর সোনার খাঁচায় রইলো না
